জটিলতায় স্থবির জাইকার ৫টি বড় প্রকল্প

০ মতামত 45 views

‎সিদ্ধান্তহীনতা ও প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে আছে জাইকার অর্থায়নে চলমান পাঁচটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প।মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রো রেল এবং বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ প্রতিটি প্রকল্পেই হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ থমকে আছে সিদ্ধান্তহীনতার ফাঁদে পড়ে। সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর বৈঠকে এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কাঁচপুর-মেঘনা-গোমতী সেতু, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, মেট্রো রেল, যমুনা রেল সেতু ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র—সব প্রকল্পই বর্তমানে কোনো না কোনো জটিলতার কারণে স্থবির অবস্থায় রয়েছে।


‎জাইকা এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করে জানিয়েছে, যদি বাস্তবায়নে সমন্বয়ের অভাব ও সিদ্ধান্তহীনতা দূর না হয়, তারা ভবিষ্যতে নতুন প্রকল্প অনুমোদনে আরো সতর্ক থাকবে।



‎জানা যায়, বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা দীর্ঘদিন ধরে অন্যতম বড় সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করছে। সড়ক, সেতু, রেল, বিদ্যুৎ ও বিমানবন্দর—সবখানেই তাদের অর্থায়নে চলছে বড় বড় প্রকল্প। একসময় উন্নয়নের রোল মডেল ছিল জাইকা অর্থায়িত প্রকল্পগুলো।


‎সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যপট একেবারে পাল্টে গেছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এখন জাইকার অর্থায়নের প্রায় সব বড় প্রকল্পই থমকে আছে।


‎শেষ হয়েও হয়নি কাঁচপুর-মেঘনা-গোমতী সেতু : ‘কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ ও পুরনো সেতুগুলোর পুনর্বাসন’ প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু এখনো এর আর্থিক নিষ্পত্তি সম্পন্ন হয়নি।


‎জাপানি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ শেষে প্রায় আট কোটি টাকার অতিরিক্ত দাবি তুলেছে, যা এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। প্রকল্পের বিরোধ নিষ্পত্তি বোর্ড দাবি স্বীকার করলেও কত অর্থ প্রদান করা হবে তা ঠিক করা হয়নি। ফলে প্রকল্প চালু হলেও হিসাবের খাতা বন্ধ হয়নি।


‎এই প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষণের দায়িত্ব এখন দেওয়া হয়েছে মাতারবাড়ী বন্দরের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে প্রশাসনিক জটিলতা ও সমন্বয়ের ঘাটতিরই প্রমাণ।


‎বিলম্বের গহ্বরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প : শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটি এখন নানা দাবি, বিরোধ ও অনুমোদনের বিলম্বে জড়িয়ে পড়েছে।



‎বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ছয় শতাধিক পরিবর্তন প্রস্তাব দিয়েছে, যার অর্ধেকেরও বেশি এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায়।


‎বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঠিকাদারদের দাবি-পাল্টা দাবি মিলিয়ে এখন বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকায়। বিমান কর্তৃপক্ষ দাবি করছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা, আর ঠিকাদার পক্ষ দাবি করছে এক হাজারেরও বেশি কোটি টাকা। এই


‎বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বোর্ড গঠন করা হলেও তা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।


‎জাইকার পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, সরকারি অনুমোদন ও সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিতে দেরির কারণে পরামর্শক ও ঠিকাদার উভয়ের বিল আটকে গেছে। এতে প্রকল্পের সময়সূচি ভেঙে পড়েছে এবং নির্মাণ ব্যয় দিন দিন বাড়ছে।


‎বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল আংশিক প্রস্তুত হলেও পুরো কাজ শেষ হতে আরো অন্তত দেড় বছর লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


‎যমুনা রেল সেতু—টানাপড়েনেই অগ্রগতি : যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি দেশের রেল যোগাযোগে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখানেও দেখা দিয়েছে দাবি, বিরোধ ও অনুমোদনের বিলম্ব। প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজ শেষ হলেও এখনো দুটি প্যাকেজে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। ঠিকাদারদের কিছু দাবির নিষ্পত্তির জন্য মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন দরকার, কিন্তু সংশোধিত প্রস্তাব এখনো পরিকল্পনা কমিশনে জমা পড়েনি।


‎জাইকা জানিয়েছে, বারবার সময় বাড়ানো ও অনুমোদন বিলম্বের কারণে তারা প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে খুব হতাশ। যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং বকেয়া অর্থ ছাড় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।


‎মেট্রো রেল লাইন ১ ও ৫—স্থবির স্বপ্ন : রাজধানীর যানজট কমানোর বড় স্বপ্ন হিসেবে শুরু হয়েছিল মেট্রো রেল প্রকল্প। কিন্তু জাইকা অর্থায়িত লাইন ১ ও লাইন ৫ এখন প্রশাসনিক জটিলতায় প্রায় থমকে আছে। লাইন ১-এর একটি বড় প্যাকেজের দরপত্র অনুমোদনের আবেদন করা হলেও জাইকা এখনো সম্মতি দেয়নি। অন্যদিকে ইউটিলিটি স্থানান্তর না হওয়ায় উত্তর বাড্ডা ও আফতাবনগর এলাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে।


‎লাইন ৫-এর একটি প্যাকেজে দরদাতার প্রস্তাব প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় এখন সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জরুরি হয়ে পড়েছে। ফলে পুরো প্রকল্পেই সময়সূচি ভেঙে পড়েছে। জাইকা জানায়, প্রকল্প পরিচালক ও জাইকার কার্যালয়ের মধ্যে যোগাযোগ ঘাটতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে জবাবদিহির অভাবই এর মূল কারণ।


‎এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জাইকার ঋণে উন্মুক্ত দরপত্রের সুযোগ নেই। টেন্ডার হলে জাপানের প্রতিষ্ঠানই শুধু অংশগ্রহণ করতে পারে। এ কারণে অনেক টেন্ডার প্রস্তাব প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি পড়ছে। এতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য দেশও যদি এখানে অংশ নিতে পারত তাহলে প্রতিযোগিতা আরো ভালো হতো। কম রেটে কাজ করানো যেত।


‎ইআরডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে প্রকল্প ব্যয় কমানো যায় কি না। সেটা নিয়ে জাইকার সঙ্গে আলোচনা চলছে। কারণ যত টাকা খরচ লাগছে মেট্রো রেল নির্মাণে তা আমাদের জন্য অত্যধিক বেশি। এত টাকা ঋণ করে মেট্রো রেল নির্মাণ আমাদের জন্য কঠিন।’


‎সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, এত উচ্চমূল্যে মেট্রো রেল নির্মাণ করা সম্ভব নয় বলে জাইকাকে জানানো হয়েছে। এখন ব্যয় কমানোর জন্য পর্যালোচনা চলছে। জাপানের সঙ্গে আলোচনা করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।


‎মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র—প্রযুক্তিগত ব্যর্থতায় দুঃস্বপ্ন : সবচেয়ে আলোচিত জাইকা অর্থায়িত প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন গভীর সংকটে। প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতি বছরের শুরু থেকে নানা প্রযুক্তিগত সমস্যায় ভুগছে। বয়লারে ছাই জমে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। ঠিকাদার সংস্থা অভিযোগ করছে যন্ত্রের নকশায় ত্রুটি ছিল, কিন্তু পরামর্শক সংস্থা তা অস্বীকার করছে।


‎প্রযুক্তিগত এই ব্যর্থতার পাশাপাশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত দাবি করছে।


‎প্রকল্প পরিচালকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের সক্ষমতা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা চুক্তির নির্ধারিত মানের অর্ধেকেরও কম। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। জাইকা এই পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছে।


‎জটিলতার মূল কারণ প্রশাসনিক অদক্ষতা ও সিদ্ধান্তহীনতা : সব প্রকল্পের আলাদা সমস্যা থাকলেও মূল সংকট তিন জায়গায়—চুক্তিগত অস্পষ্টতা, অনুমোদনের বিলম্ব এবং প্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতি। জাইকার মতে, বাংলাদেশের সরকারি সংস্থাগুলো সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এতে শুধু খরচই বাড়ছে না, বরং বিদেশি সহযোগীদের আস্থাও কমছে।


‎অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, জাইকার নিজস্ব প্রক্রিয়াও অত্যন্ত ধীরগতি ও জটিল; প্রতিটি সিদ্ধান্তে টোকিওর অনুমোদন নিতে হয় বলে সময় অনেক বাড়ে।


‎ইআরডি ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বিদেশি শর্ত ও জটিল অনুমোদন প্রক্রিয়ার কারণে অনেক সময় তাঁরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে, কাজ থেমে যায়, আর শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রত্যাশা অপূর্ণ থেকে যায়।

Leave a Comment