বিডিআর হত্যাযজ্ঞের তদন্ত প্রতিবেদন: বিস্ফোরক ফাইন্ডিংস জমা, কাঠগড়ায় তৎকালীন সরকারি দল আওয়ামী লীগ

০ মতামত 35 views

বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত দেশের ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তদন্ত প্রতিবেদনটি অবশেষে জমা দিয়েছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। রবিবার (৩০ নভেম্বর, ২০২৫) কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান সহ সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।

প্রধান উপদেষ্টা কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এই প্রতিবেদনে শিক্ষণীয় বহু বিষয় এসেছে এবং এটি জাতির জন্য মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে। তিনি স্বীকার করেন যে জাতি এই ভয়াবহতম ঘটনা নিয়ে দীর্ঘকাল অন্ধকারে ছিল এবং এই কাজের মাধ্যমে বহু প্রশ্নের অবসান ঘটবে।


মূল বিডিআর বিদ্রোহের (২০০৯) প্রেক্ষাপটে নতুন প্রতিবেদন: পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ

২০০৯ সালের পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৬ বছর পর জমা দেওয়া এই প্রতিবেদনটি ঘটনার প্রকৃতি ও মূল ষড়যন্ত্রকারী কারা ছিলেন, সে বিষয়ে অত্যন্ত বিস্ফোরক দাবি উত্থাপন করেছে, যা তৎকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। কমিশন এই ঘটনাকে নিছক কোনো বিদ্রোহ নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তাদের ফাইন্ডিংসের মাধ্যমে ২০০৯ সালের সেই ভয়াবহ দিনের আসল চালচিত্র উদঘাটনের চেষ্টা করেছে।

কমিশন প্রধান ফজলুর রহমান উল্লেখ করেন, তদন্ত কাজ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব বজায় রাখা হয়েছে, যদিও ১৬ বছর আগের বহু আলামত ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।

তদন্ত কমিশনের মূল ও বিতর্কিত দাবি:

কমিশনের অন্যতম সদস্য মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার (অব.) এবং কমিশন প্রধান ফজলুর রহমান তাদের বক্তব্যে এই হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সরাসরি যোগসাজশের শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছেন:

  • বহিঃশক্তি ও ক্ষমতাসীন দলের সম্পৃক্ততা: তদন্তে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণ মিলেছে বলে দাবি করেন ফজলুর রহমান।
  • প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা: জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার জোর দিয়ে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং এর পেছনে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস
  • প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’: সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগে তিনি বলেন, পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল।
  • স্থানীয় আওয়ামী লীগের সুরক্ষা: হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের রক্ষা করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সরাসরি ভূমিকা রেখেছে বলেও অভিযোগ করা হয়। এ প্রসঙ্গে তারা জানান, ২০ থেকে ২৫ জনের একটি মিছিল পিলখানায় ঢুকেছিল এবং বের হওয়ার সময় সেই মিছিলে দুই শতাধিক মানুষ ছিল।
  • দায় ও ব্যর্থতা: জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার সুস্পষ্টভাবে এই ঘটনার দায় তৎকালীন সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সেনাপ্রধানেরও বলে উল্লেখ করেন।
  • সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা: তদন্তে বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা হয়েছে, কেন সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে থাকল এবং সময়মতো অ্যাকশন নিল না। এই প্রশ্নে জনমনে থাকা প্রতিটি উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান কমিশন প্রধান।
  • গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও গণমাধ্যম: পুলিশ, র‍্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতা ছিল বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পাশাপাশি কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং কয়েকজন সাংবাদিকের ভূমিকা অপেশাদার ছিল বলে জানানো হয়।
  • তথ্য সংরক্ষণে ত্রুটি: হত্যাকাণ্ডের সময় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) যেসব বিডিআর সদস্যের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন, তাদের সঠিক নাম, পরিচয় ও তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি বলেও কমিশন উল্লেখ করেছে।

এই প্রতিবেদনটি বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে সংস্কার এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি দিকনির্দেশনা দেবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়ানো যায় এবং এই ঘটনার ভিকটিমরা ন্যায়বিচার পায়।

Leave a Comment