অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা: নীরব মহামারির পথে মানবস্বাস্থ্য

০ মতামত 26 views

অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে চিকিৎসকের পরামর্শ এড়িয়ে যাওয়া কিংবা মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বা অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুর সমস্যা আর ভবিষ্যতের কোনো আশঙ্কা নয়—এটি আজই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বিশাল চাপ তৈরি করছে।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, আইসিইউতে ভর্তি প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৪ জন রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হচ্ছে না। এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, সাধারণ সংক্রমণ মোকাবিলার আমাদের সক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

আরও উদ্বেগজনক হলো শেষ পর্যায়ের অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর কার্যকারিতা কমে যাওয়ার প্রবণতা। মেরোপেনেমের মতো গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ২০২২ সালের ৪৬.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ৭১ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যান্য প্রধান অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধও ৭৯ থেকে ৯৭ শতাংশ—যা কার্যত আমাদের শেষ প্রতিরোধব্যুহকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

এএমআর-এর প্রভাব শুধু হাসপাতালের দেয়ালের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০১৯ সালে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে ১২.৭ লাখ মানুষ সরাসরি মারা গেছেন এবং আরও প্রায় ৫০ লাখ মৃত্যুর সঙ্গে এটি জড়িত ছিল। গবেষকদের আশঙ্কা, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতিবছর এএমআর-জনিত মৃত্যুর সংখ্যা এক কোটিতে পৌঁছাতে পারে—ক্যানসারের মৃত্যুহারকেও ছাড়িয়ে যাবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে; বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে এর ফলে প্রতি বছর ১ থেকে ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে।

এই প্রবণতা আমাদেরকে অ্যান্টিবায়োটিক-পূর্ব যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে—যখন সাধারণ সংক্রমণেই মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল, অস্ত্রোপচার ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, আর আধুনিক চিকিৎসার অগ্রগতি ছিল অসম্ভব। ক্যানসার চিকিৎসা, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, সিজারিয়ান অপারেশন কিংবা আইসিইউ সেবা—সবকিছুই নির্ভর করে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর। সেই ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেলে চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিক কাঠামোই নড়বড়ে হয়ে পড়বে।

এই সংকটের প্রধান কারণ মানবিক অসচেতনতা। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কেনা, নিজের ইচ্ছেমতো ডোজ নির্ধারণ, এবং উপসর্গ কমলেই ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া—এসব অভ্যাস শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়া টিকে থাকতে সাহায্য করে এবং প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। বাজারে ওভার-দ্য-কাউন্টার সহজলভ্যতাও সমস্যাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যেও একাধিক ত্রুটি রয়েছে—অনেক চিকিৎসকের রোগনির্ণয় পরীক্ষাবিহীন অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন, হাসপাতালে দুর্বল সংক্রমণনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, এবং সর্বত্র কালচার-সেনসিটিভিটি টেস্ট প্রচলিত না থাকা এসবের অন্যতম।

এ ছাড়াও কৃষি ও পশুপালনে অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, ওষুধ শিল্পের দূষণ, এবং নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উন্নয়নে অনীহা—সমষ্টিগতভাবে একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে, যার ফল ভুগছে সমাজ।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অননুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ, পরীক্ষানির্ভর চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ, হাসপাতালভিত্তিক স্টুয়ার্ডশিপ প্রোগ্রাম চালু, কৃষিখাতে ব্যবহার কমানো, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি—সবই জরুরি করণীয়।

সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি। মানুষকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে—অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসে কাজ করে না, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটি গ্রহণ করা উচিত নয়, এবং সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করতেই হবে।
অ্যান্টিবায়োটিক কোনো অসীম সম্পদ নয়—আজ অবহেলা করলে ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যব্যবস্থাই বিপন্ন হয়ে পড়বে।

Leave a Comment