জুলাইযোদ্ধা হাদি হত্যাচেষ্টা নিয়ে রাজনৈতিক নাটক, বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্বে উত্তাল!

০ মতামত 21 views

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর সংঘটিত নির্মম হত্যাচেষ্টাকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এই জঘন্য অপরাধের বিচার এবং দোষীদের দ্রুত শনাক্তকরণের অনিবার্য দাবির পরিবর্তে, ঘটনাটি বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুঁড়ি, অভিযোগ এবং ইঙ্গিতপূর্ণ রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এখন পাল্টাপাল্টি অভিযোগে সরগরম।

গত শুক্রবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেল আরোহী সন্ত্রাসীরা ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত হাদিকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইনকিলাব মঞ্চ নিশ্চিত করেছে, হাদির অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘটনাটির তীব্র নিন্দা জানালেও, কিছুদিনের মধ্যেই বিএনপি ও জামায়াত প্রকাশ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।

ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে বিতর্কের সূত্রপাত

উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটে ডাকসু ভিপি ও ছাত্রশিবির নেতা সাদিক কায়েমের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের দিকে বিক্ষুব্ধ জনতার ‘তেড়ে’ যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

হাদির ওপর হামলার প্রায় ২০ মিনিট পর সাদিক কায়েম তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি লেখেন— ‘ওসমান হাদিকে গুলি করা হলো। চাঁদাবাজ ও গ্যাংস্টারদের কবল থেকে ঢাকা সিটিকে মুক্ত করতে অচিরেই আমাদের অভ্যুত্থান শুরু হবে।’ অভিযোগ ওঠে, ‘চাঁদাবাজ ও গ্যাংস্টার’ শব্দগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে বিএনপিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

একইভাবে, হামলার রাতেই জামায়াতে ইসলামীর আমির তাঁর ফেসবুকে একটি ইঙ্গিতপূর্ণ স্ট্যাটাস দেন। তিনি লেখেন— ‘কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মতভিন্নতার কারণে এ ধরনের সহিংসতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।’

হাসপাতালে মির্জা আব্বাসকে ঘিরে তীব্র ক্ষোভ

এদিকে, আহত হাদিকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ওসমান হাদির সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাস। তিনি পৌঁছানো মাত্রই উপস্থিত জনতা ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে শুরু করে এবং সেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, জনতা তাঁর দিকে তেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যান।

এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মির্জা আব্বাস সহানুভূতি জানাতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে পরিকল্পিতভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি ও মব তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বিএনপির ওপর আঘাত এলে দল বসে থাকবে না এবং কীভাবে এর জবাব দিতে হয়, তা বিএনপি জানে।

নয়াপল্টনের সমাবেশে পাল্টা আক্রমণের ঝড়

পরদিন নয়াপল্টনে ওসমান হাদি ও চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত এক সমাবেশে মির্জা আব্বাস বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, হাদিকে গুলি করার মাধ্যমে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এই হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে’।

ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমের ফেসবুক পোস্টের প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, ‘হাদির গায়ে গুলি লেগেছে বেলা সোয়া ২টায়। ঠিক আড়াইটার সময় ফেসবুকে পোস্ট এলো, সবাই যে যেখানে আছো, ঐক্যবদ্ধ হও। কোনো একটা বাসায় যেতে হবে, ইট খুলে নিয়ে আসতে হবে। ভাবতে পারছেন ব্যাপারটা কত পরিকল্পিত।’

হাসপাতালের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মির্জা আব্বাস আরও বলেন, ‘আমি ঢাকার রাজপথে আন্দোলন করে বড় হয়েছি। আমি ওই মুহূর্তে শান্ত থেকেছি, নীরব থেকেছি। সে সময় যদি আমার নির্দেশনা পেত, তাহলে তোমাদের তুলাধুনা করতে আমাদের ছেলেরা দেরি করত না।’ তিনি জোর দিয়ে দাবি করেন, যারা আক্রমণাত্মক স্লোগান দিচ্ছিল, তারা ওসমান হাদির সমর্থক নয়। তারা ছিল ‘বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা’, যারা ‘চেয়েছিল হাদি ওখানেই মারা যাক’।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি এটিকে ‘সুপরিকল্পিত একটা বিষয়’ দাবি করে বলেন, হামলাকারী হিসেবে যাকে শনাক্ত করা হয়েছে, সে ছাত্রলীগের নেতা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি সাদিক কায়েমের সঙ্গে একই টেবিলে চা খাচ্ছে।

ডিএমপি কমিশনারকে জড়িয়ে ভুয়া তথ্য: রিজভীর দুঃখ প্রকাশ

রিজভী একপর্যায়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের বরাতে একটি বক্তব্যের উল্লেখ করেন, যেখানে হামলাকারীর সঙ্গে সাদিক কায়েমের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। তবে, পরে ডিএমপি স্পর্শকাতর এই বক্তব্যটিকে সম্পূর্ণ ভুয়া এবং এআই দিয়ে তৈরি ছবি নির্ভর বলে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করে।

এ ঘটনার পর সাদিক কায়েম ও জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে রিজভীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানায় এবং তা প্রত্যাহারের দাবি তোলে। সাদিক কায়েম ফেসবুকে বলেন, ‘আওয়ামী প্রোপাগান্ডা সেল কর্তৃক প্রচারিত এআই জেনারেটেড ছবিকে সত্য ধরে নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতা রুহুল কবীর রিজভী শরীফ ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টাকারীর সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে যে অপতথ্য ছড়িয়েছেন, তা কোনোভাবে প্রত্যাশিত দায়িত্বশীল আচরণ নয়।’ তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে বিএনপি এবং রিজভীকে অপতথ্য ছড়ানোর অপরাধ থেকে দায়মুক্ত করার আহ্বান জানান। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের রিজভীর বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচারবিরোধী’ বলে আখ্যা দেন।

পরে রাতে রুহুল কবির রিজভী তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এআই-জেনারেটেড ছবি ও ভুয়া তথ্য যাচাই না করেই তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।


হাদি হত্যাচেষ্টা নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের এই পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

Leave a Comment